সৌদি আরব-যুক্তরাষ্ট্রের বৈঠকটি সাম্প্রতিক নানা কারণে ব্যাপক গুরুত্বপূর্ণ। সফরের আগে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন গত মাসে (১৭ জুন) দৃঢ়চিত্তে বলেছিলেন, তিনি সৌদি আরব সফর করলেও যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে দেখা করবেন না। অথচ তিনি সৌদি আরব গেলেন, যুবরাজের সঙ্গে দেখা করলেন, বৈঠকও করলেন।
মার্কিন প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেয়ার পর সৌদি-যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের ব্যাপক অবনতি ঘটে। সৌদি রাজতন্ত্রের সমালোচক সাংবাদিক জামাল খাশোগির হত্যাকাণ্ডে যুবরাজকে ‘খুনি’ বলতেও দ্বিধা করেননি মার্কিন প্রেসিডেন্ট। কিন্তু চলতি মধ্যপ্রাচ্য সফরেই পল্টি দিলেন জো বাইডেন।
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ বাস্তবতায় বাইডেনের এ সফর বৈশ্বিক ভূরাজনীতির জন্য ব্যাপক তাৎপর্যপূর্ণ। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেছেন, মধ্যপ্রাচ্য থেকে বের হচ্ছে না যুক্তরাষ্ট্র। অর্থাৎ তারা আগের মতোই এ অঞ্চলে দৃষ্টিপাত রাখতে চায়। মূলত মধ্যপ্রাচ্যকে ইরান, চীন ও রাশিয়ার প্রভাবমুক্ত করতে তৎপর চীন।
চারদিনের মধ্যপ্রাচ্য সফরে ছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। ইসরাইল ও ফিলিস্তিন সফর শেষে শুক্রবার (১৫ জুলাই) সৌদি আরব যান তিনি। পরদিন শনিবার (১৬ জুলাই) আরব নেতাদের সঙ্গে এক সম্মেলনে যোগ দেন বাইডেন।
আরব শীর্ষ সম্মেলনে গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিলের (জিসিসি) ছয় দেশ সৌদি আরব, কাতার, বাহরাইন, কুয়েত, ওমান ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের পাশাপাশি জর্ডান, মিসর ও ইরাকের নেতারাও অংশ নেন।
সফরে বাইডেন নিরাপত্তা থেকে অর্থনীতি, আঞ্চলিক সহযোগিতা থেকে বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা এবং জ্বালানি বাস্তবতার বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করেন। বাইডেন বলেন, আমরা মধ্যপ্রাচ্য থেকে সরছি না। এমনকি এমন কোনো শূন্যস্থান রাখা হবে না যা রাশিয়া, চীন, কিংবা ইরান পূরণ করবে।
বৈঠকে মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার দেশগুলোর জন্য ১০০ কোটি ডলারের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ প্রকল্পের ঘোষণা দিতে দেখা যায় জো বাইডেনকে। এ সময় তিনি ‘নিউ ফ্রেমওয়ার্ক ফর দ্য মিডলইস্ট’ নীতিমালার ঘোষণা দেন। এই নীতিমালার আওতায় মধ্যপ্রাচ্যের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, নিরাপত্তা ও গণতান্ত্রিক স্বাধীনতাকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
মধ্যপ্রাচ্য সফরের পেছনে বাইডেনের অন্যতম লক্ষ্য— আরব বিশ্বের সঙ্গে ইসরাইলকে একীভূত করা এবং ইরানের বিরুদ্ধে যৌথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা। সম্মেলনে ইরান প্রসঙ্গে বাইডেন বলেন, ইরান যাতে পরমাণু অস্ত্রে সমৃদ্ধ হতে না পারে সে ব্যাপারে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ যুক্তরাষ্ট্র। ইরানের পরমাণু অস্ত্র অর্জন ঠেকাতে যৌথভাবে কাজ করবে যুক্তরাষ্ট-ইসরাইল।
বাইডেনের মধ্যপ্রাচ্য সফরে একটি অর্জন হলো— ইসরাইলের বিমান চলাচলে সৌদির নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার। সৌদির কাছে এখনো স্বীকৃতি না পাওয়ায় এতদিন ইসরাইল সৌদির আকাশে বিমান পরিচালনা করতে পারত না। কিন্তু গত বৃহস্পতিবার (১৪ জুলাই) সৌদি নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ায় প্রথমবারের মতো ইসরাইলে থেকে সরাসরি ফ্লাইটে জেদ্দা পৌঁছান বাইডেন। শুক্রবার (১৫ জুলাই) রিয়াদ এক বিবৃতিতে জানায়, জ্বালানি, মহাকাশ, স্বাস্থ্য, বিনিয়োগ ও প্রযুক্তিবিষয়ক ১৮টি চুক্তিতে স্বাক্ষর করে সৌদি-যুক্তরাষ্ট্র।
যুক্তরাষ্ট্র যখন সৌদি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল, তখন বিশ্ববাজারে তেলের ছাড়াছড়ি ছিল। দামও নিম্নমুখী ছিল। কিন্তু ইউক্রেনে যুদ্ধে বিশ্ব বাজারে তেলের দাম ও সংকট বেড়েছে। এদিকে আগামী নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রে মধ্যবর্তী নির্বাচন। দেশটিতে এখন জ্বালানির দাম চড়া। এ অবস্থায় জ্বালানির দামে লাগাম টানতে না পারলে বাইডেনের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন ও ডেমোক্র্যাটরা চাপে পড়তে পারে। বাইডেনের ধারণা, সৌদি যদি তেলের উত্তোলন বাড়াতে পারে, তাহলে জ্বালানির দামে লাগাম টানতে পারবেন।
কিন্তু সৌদি আরব বোঝাচ্ছে, তারা সাধ্যমতোই তেল উত্তোলন করছে, এমনকি রাশিয়া থেকেও তাদের তেল কিনতে হচ্ছে। বাইডেন চাইছেন, পেট্রোলিয়াম রফতানিকারক জোট— ওপেক বেশি বেশি তেল উত্তোলন করুক। কিন্তু এ বিষয়ে ইতিবাচক কোনো সাড়া পাননি তিনি।
আল জাজিরার হোয়াইট হাউস সংবাদদাতা কিমবার্লি হ্যালকেটের মতে, রাজনৈতিক অর্জন বিবেচনায় বাইডেন কিছু পাননি। তাকে ‘খালি হাতে’ দেশে ফিরতে হয়েছে।
আল জাজিরার জ্যেষ্ঠ রাজনৈতিক বিশ্লেষক মারওয়ান বিশারা মনে করেন, বাইডেনের ইসরাইলে যাত্রাবিরতির চেয়ে সৌদি আরব সফর বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। অন্যদিকে বিবিসির সাংবাদিক অ্যানা ফস্টারের প্রতিবেদন বলছে, বাইডেনের এ সফরে রিয়াদ খুব ‘কৌশলী’ ছিল। বিশ্ব সম্প্রদায়কে সৌদি প্রশাসন বোঝাতে সক্ষম হয়েছে, তারা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অপরিহার্য এবং তারা এবার ‘দাতার’ ভূমিকায়।
তথ্যসূত্র: এএফপি, রয়টার্স, বিবিসি ও আলজাজিরা
বাংলাদেশ সময়: ১১:৩৭:৩২ ২৪৫ বার পঠিত