সাগরের স্বর্গোদ্যান সাইপ্রাস

প্রথম পাতা » ছবি গ্যালারী » সাগরের স্বর্গোদ্যান সাইপ্রাস
রবিবার, ১৭ জুন ২০১৮



জাতিসংঘের কাজে নিয়োজিত থাকাকালে আমার সাইপ্রাসে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়। একবার নয়, কয়েকবার। প্রতিবারই কমপক্ষে সাত দিন অবস্থান। জাতিসংঘের গাড়ি থাকার কারণে ঘোরাফেরা করতে কোনো অসুবিধা হয়নি। এ কারণে সাইপ্রাসের ছয়টি জেলার প্রায় প্রতিটি উল্লেখযোগ্য স্থানেই যাওয়া সম্ভব হয়েছে।

সাইপ্রাস ভূমধ্যসাগরের বুকে একটি ছোট দ্বীপ দেশ। অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন, শোভাময় ও অরণ্য-পর্বতবেষ্টিত এক সুদৃশ্য নন্দনকানন। এটি দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের সর্বশেষ সীমায় অবস্থিত। দেশটি তুরস্কের ৭০ কিলোমিটার দক্ষিণে, সিরিয়া উপকূলের ১০০ কিলোমিটার পশ্চিমে এবং গ্রিসের ২৭০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত। আয়তন ৯২৫১ বর্গকিলোমিটার। জনসংখ্যা প্রায় ১৪ লাখ। বারবার দেশটিতে ঘুরে বেড়ানোতে জানা গেছে এর এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তের দৈর্ঘ্য ২২৫ কিমি এবং প্রস্থ ৯৪ কিমি। মাথাপিছু আয় ৩১,২৫০ মার্কিন ডলার (২০১৭)। স্বাস্থ্যসম্মত আবহাওয়া এবং চমৎকার নৈসর্গিক দৃশ্যাবলির কারণে এখানে সারা বছর পর্যটকের ভিড় লেগেই থাকে। দেশটির সর্বত্রই সবুজ শ্যামলিমা। পথেঘাটে রাস্তার দুই পাশে প্রায়ই আগাছার মতো আঙুরলতা ছড়িয়ে আছে। চাষকৃত আঙুর বাগানসহ রয়েছে প্রচুর রসনারোচক ফলÑ স্ট্রবেরি, তিন, চেরি, মাল্টা, কমলা, আপেল কিংবা অলিভ। ছোট এ দ্বীপ দেশের সব মানুষের চোখে-মুখে দেখেছি সন্তোষের আভা, শান্তির সুস্পষ্ট বহিঃপ্রকাশ। এ ছাড়া সেখানে রয়েছে অসংখ্য প্রাচীন প্রতœতাত্ত্বিক ঐতিহ্য এবং সে দেশের মানুষের প্রথাগত আতিথেয়তা। সাইপ্রাসের যেখানেই গেছি সেখানেই পেয়েছি বাংলাদেশি যুবক ছেলেদের। এ কারণে কোনো দর্শনীয় স্থান দেখতে গেলে বাঙালি ছেলেদের সঙ্গে নিয়েই গেছি। রাষ্ট্রভাষা ইংরেজি হওয়ার কারণে এখানকার সবাই এ ভাষায় সাবলীল কথা বলতে পারে।

সাইপ্রাসে কোনো ধরনের উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই। রাজধানী নিকোশিয়ায় একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থাকলেও সেখানে শিক্ষার গুণগতমান আশাব্যঞ্জক নয়। আর সারা দেশে রয়েছে ৬টি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়। অথচ প্রতিদিন আমাদের দেশের অধিকাংশ সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়Ñ‘উচ্চশিক্ষার্থে সাইপ্রাস গমন করুন’। দ্বীপ দেশটিতে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত বিষয়গুলোর মধ্যে বিদেশি শিক্ষার্থীরা সাধারণত হোটেল ম্যানেজমেন্ট, হোটেল মেইনটেন্যা›স, এয়ার হোস্টেস ইত্যাদি বিষয়ের ওপর ডিপ্লোমা সম্পন্ন করে থাকে।

একদিন নিকোশিয়া থেকে লিমাসল যেতে খালিদ নামের একজন প্রবাসী বাঙালি ছেলে আমার সহযাত্রী হয়। সে জানায়, ‘আমি মিলোনিয়াম ইয়ারে এখানে এসেছি। আমার এসএসসি ও এইচএসসি দুটোতেই স্টার মার্কস ছিল। কিন্তু এখানে পড়াশোনার জন্য উচ্চশিক্ষার জায়গা নেই। যেহেতু ৬ লাখ টাকা খরচ করে এসেছি ফিরে যাই কীভাবে! এ জন্য হোটেল ম্যানেজমেন্টের ওপর শিক্ষা গ্রহণ করেছি। ১০ বছরেও ইচ্ছে করে পাস করিনি। পাস করলেই দেশ থেকে বের করে দেবে। যদিও প্রতি মাসে কলেজে ৩০০ ইউরো দিতে হয়।’

জানতে চাইলাম, ‘এত টাকা জোগাড় কর কীভাবে?’

সে জানাল, ‘দিনরাত পার্টটাইম কাজ করে আমি এখন কমপক্ষে ২০০০ ইউরো আয় করতে পারি। সব মিলিয়ে খরচ হয় ৬ থেকে ৭ শ ইউরো। বাকিটা ওয়েস্টার্ন ইউনিয়নের মাধ্যমে দেশে পাঠাই।’

খালিদের মতো অধিকাংশ ছেলেরাই এখানে ভালো আছে। বাঙালি শিক্ষিত শিক্ষার্থীরা দ্রুত ইংরেজি শেখার ফলে হোটেলে কাজ করতে সমস্যা হয় না। ছোট দেশটিতে রয়েছে প্রায় দুই হাজার আবাসিক হোটেল, শত শত নাইট ক্লাব, সুপার নাইট ক্লাব। সন্ধের পর যেখানে বসানো হয় উদ্দাম নাচের আসর। লিমাসলের সুপার নাইট ক্লাবগুলো অনেকটাই নেভাদা স্টেটের লাসভেগাসের মতো। উদ্দাম নাচের আসরে পাওয়া যায় রাশান, বাল্টিক অঞ্চল এবং দু-একজন মরোক্কান আর প্রাচ্যের মেয়েদের।

খালিদকে নিয়ে চলতি পথে কিছু সময়ের জন্য যাত্রাবিরতি করে দেখতে যাই কোরিও হোম দুর্গ। প্রাচীন রাজন্যবর্গ ও সামন্ত প্রভুদের মনোরঞ্জনের জন্য অনুষ্ঠিত প্রাণপণ যুদ্ধের মল্লভূমি। এতে অংশগ্রহণ করত কঠোরভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ক্রীতদাসরা ও সিংহ। একই দিন কোরিও হোম পরিদর্শনে এসেছিল তুরস্কের একটি স্কুলের শিক্ষার্থীরা। তাদের সাথেও আমরা কুশল বিনিময় করি। পুরনো দিনের বড় বড় পাথরের চাঁই দিয়ে তৈরি করা হয়েছে দুর্গটি এবং মল্লযুদ্ধ উপভোগের জন্য আসনগুলো। কোরিও হোম দর্শন শেষে খালিদকে নিয়ে যাই লিমাসল বন্দরে। লিমাসল বিশ্বের অন্যতম সেরা আন্তর্জাতিক সমুদ্রবন্দর। এই বন্দরে রয়েছে বেশ কয়টি মেরিনা, সি-বিচ, জাহাজ মেরামত কারখানা। এ ছাড়া সেখানে রয়েছে সুরম্য অট্টালিকায় আধুনিকতার ছোঁয়াসহ প্রাচীনকালে ব্যবহৃত আসবাবপত্র এবং শিল্পকর্মের দোকান। রয়েছে বিস্তর আবাসিক হোটেল এবং নাইট ক্লাব।

২০১১ সালের প্রথম দিকে আবার সাইপ্রাসে যাই। এবার নিকোশিয়ায় না থেকে অবস্থান নিলাম লিমাসলে। এখানেও প্রবাসী বাঙালি ছাত্র প্রচুর। প্রতিদিনই তাদের সাথে পরিচয় হয়, কথা হয়। কারও কারও সাথে একত্রে ঘুরে বেড়াই। একদিন গালিবের সঙ্গে পরিচয় হয়, সাথে তার শ্বেতাঙ্গিনী স্ত্রী রাশা। রাশা লিথুয়ানিয়ার অধিবাসী। বুলগেরিয়া, বেলারুশ ও বাল্টিক সাগর তীরবর্তী দেশ এস্তোনিয়া, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়ার ছেলেমেয়েরা এখানে এসেছে নামমাত্র পড়াশোনা এবং জীবিকার প্রয়োজনে। আর এসেছে প্রাচ্যের কিছু ছেলেমেয়েসহ শিক্ষার্থী হিসেবে বাঙালি ছেলেরা। বাংলাদেশ থেকে আগত কমপক্ষে ৫ শতাংশ ছেলেরা বাল্টিক অঞ্চলীয় মেয়েদের সাথে প্রেম থেকে প্রণয়ঘটিত ব্যাপার পর্যন্ত অগ্রসর হয়। ইউরোপীয় মেয়েদের বিয়ে করতে পারলে পরবর্তী সময়ে ওয়েস্টার্ন কান্ট্রিতে যেতে কিংবা সেখানে কাজ পেতে কোনো বাধা থাকে না। উল্লেখ্য, কোনো বাঙালি ছাত্র ইচ্ছে করলেই সহজেই প্রাচ্যের মেয়েদের বিয়ে করতে পারে।

গালিব ও তার স্ত্রী রাশাকে সঙ্গে নিয়ে এবার যাই লারকানা জেলার লারকানা সল্টে। যেখানে রয়েছে ঐতিহাসিক সমাধি শিলা। সুমহান ইসলামের পবিত্র নিদর্শন। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর অন্যতম মহিলা সাহাবি হজরত উম্মে হারাম (রা.)-এর মাজার শরিফ। এখানে মাজার শরিফে নেই কোনো খাদেম, দানবাক্স কিংবা আগরবাতি-মোমবাতি বাণ্যিজের অবাধ প্রসার। হজরত উম্মে হারামকে মহানবী (সা.) খালা বলে সম্বোধন করতেন। হজরত ওসমান (রা.)-এর খেলাফতকালে সিরিয়ার শাসনকর্তা হজরত আমির মুয়ারিয়া খলিফার অনুমতিক্রমে একটি শক্তিশালী নৌবহরের সাহায্যে সাইপ্রাস আক্রমণ করেন। ৬৪৯ সালের সেই অভিযানে নৌ সেনাপতি আবদুল্লাহ বিন কায়েসের নেতৃত্বে সাইপ্রাস অধিকৃত হয়। মুসলিম নৌবহরের নৌ সেনাদলে স্বামীর সাথে হজরত উম্মে হারামও ছিলেন। দখলকৃত সাইপ্রাসের লারকানার কাছে ঘোড়ার পিঠের ওপর থেকে পড়ে এই মহীয়সী রমণী শহীদ হন। নৌযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী নারীদের মাঝে তিনিই সর্বপ্রথম শাহাদাত বরণ করেন। পরে লারকানা সল্টেই তাকে সমাহিত করা হয়। সমুদ্রের সন্নিকটেই তার পবিত্র সমাধিসৌধ। মাজারটিসহ তৎসংলগ্ন মসজিদটির নির্মাণশৈলী নান্দনিক সৌন্দর্যে ভরপুর। অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন পারিপর্শ্বিকতায় মনোরম পরিবেশ। সেখানে গেলে দেহমনে অনাবিল প্রশান্তি নেমে আসে। প্রতিদিন শত শত পর্যটক এ সমাধিফলক পরিদর্শনে আসে। সেদিন গালিব ও তার বিদেশি স্ত্রীসহ আমরা মাজার জেয়ারত করি।

পরদিন আবার গালিব দম্পতিকে নিয়ে বের হই। যাই বিখ্যাত ওয়াইন ভিলেজে। হাজার হাজার বছর ধরে এ গ্রামের লোকেরা মদ তৈরি করে। নিজেরা খায় এবং বাজারজাত করে। ওয়াইন ভিলেজের নাম ওমোডস। এই ওমোডসের প্রতিটি পরিবারই যারপরনাই অতিথিপরায়ণ। আমার যেখানেই গেছি সেখানেই আপ্যায়িত হয়েছি। প্রতিটি বাসাসংলগ্ন দোকানে বিভিন্ন ধরনের মদ সাজানো রয়েছে। তৈরিকৃত প্রতিটি মদ টেস্ট করার জন্য রয়েছে ফ্রি স্যাম্পল। এখানে শত প্রকার মদ ইচ্ছেমতো ফ্রি টেস্টের সুযোগ রয়েছে। সেখানে অনেক উন্নত মানের মদ তৈরি হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ওমোডসের মদের বিপুল চাহিদা রয়েছে। এখানকার বাসিন্দারা প্রত্যেকে আগত অতিথিদের অভ্যর্থনা জানায়। কেউ সেখানে গেলে ওয়াইনসহ লাইট রিফ্রেশমেন্ট দিয়ে সমাদর করে। এই মনোমুগ্ধকর গ্রাম এবং এর প্রতিটি পরিবারের ঐতিহ্যগত আতিথেয়তায় আমরা মুগ্ধ হয়েছি।

ওমোডস ভিজিটের পর ফেরার পথে একই দিন ফামাগুস্তা গেটের কাছে পোডাকাট্রোতে দৃষ্টিনন্দন লিবার্টি মনুমেন্ট দেখার সুযোগ হয়। স্বাধীনতা বা মুক্তি স্মৃতিস্তম্ভ ১৯৭৩ সালে নির্মিত হয়। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে সচেতন জনতা বিদ্রোহ করলে ইংরেজ সরকার তাদের গণহারে কারাগারে শাস্তির ব্যবস্থা করে। ব্রিটিশ শাসন অবসানের পরিসমাপ্তিতে ১৯৫৯ সালে স্বাধীনতাকামীদের কয়েদখানা থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। বন্দিশালা থেকে মুক্তির স্মৃতিরক্ষার্থেই চিত্তাকর্ষক স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়।

ভূমধ্যসাগরের টিপ (তিলক) সাইপ্রাস দ্বীপ। এখানে রয়েছে- নিকোশিয়া, লিমাসল, লারকানা, পাফোস, কেরিনিয়া ও ফামাগুস্তা নামে ছয়টি জেলা। আর সব জেলাতেই রয়েছে প্রচুর ঐতিহাসিক অতীত নিদর্শন, অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং আধুনিক স্থাপত্যের ছোঁয়া। একবার সাইপ্রাস ভ্রমণ করলে আপনার বারবারই যেতে ইচ্ছে করবে। সে দেশের আকর্ষণীয় নৈসর্গিক লাবণ্য, নিরুপদ্রব চলাফেরা, মানুষের অবাধ কর্মচাঞ্চল্য ও সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাব আপনাকে নিরন্তর আকর্ষণ করবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৬:৫৫:৩৪   ৫২০ বার পঠিত  




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

ছবি গ্যালারী’র আরও খবর


ঝিনাইদহে দুই বাসের সংঘর্ষ, আহত ১৫
সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলেন অনু কাপুর
নোয়াখালীতে সরকারি আবাসিক ফ্ল্যাটের উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী
ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় চালু হচ্ছে আর্জেন্টিনার দূতাবাস
টস হেরে প্রথমে ব্যাটিংয়ে নাসিরের ঢাকা
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আরসার কমান্ডারসহ গ্রেফতার ৫
বাজারে আসছে স্যামসাং গ্যালাক্সি এস২৩ সিরিজের ফোন
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মধ্যপ্রাচ্য সফর শুরু
রবীন্দ্রনাথের গল্প ও সুর মানুষকে সঠিক পথ দেখিয়েছে - খাদ্যমন্ত্রী
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর মহাপরিচালকের শ্রদ্ধা

আর্কাইভ