নীলফামারীর সৈয়দপুরে ডায়েরির পাতায় সুইসাইড নোট লিখে ঘুমের ওষুধ খেয়ে গৃহবধূ জ্যোতি আগারওয়ালের মৃত্যুর ঘটনায় তার স্বামী সুমিত কুমার আগারওয়াল নিক্কিকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
রোববার (১৮ সেপ্টেম্বর) মধ্যরাতে রংপুর মেডিকেল কলেজ চত্বর থেকে সুমিতকে গ্রেফতার করা হয়।
এর আগে রাতেই সৈয়দপুর থানায় জ্যোতির বড়ভাই বিমল কুমার সুমিত কুমার আগারওয়াল নিক্কি, শাশুড়ি উমা দেবী আগারওয়াল, দেবর অমিত কুমার আগারওয়াল ও জা ডা. অমৃতা কুমারী আগারওয়ালের বিরুদ্ধে আত্মহত্যা প্ররোচনার মাললা করেন।
সৈয়দপুর থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সাইফুল ইসলাম সময় সংবাদকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
এর আগে রোববার (১৮ সেপ্টেম্বর) দুপুরে গৃহবধূর মৃত্যুর খবরে স্বামীসহ পরিবারের লোকজন গা ঢাকা দেন।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ইন্দ্র মোহন সময় সংবাদকে বলেন, মামলায় বাকি আসামিদের গ্রেফতার করতে পুলিশ অভিযান অব্যাহত রেখেছে।
জ্যোতির বড় ভাই বিমল কুমারের অভিযোগ, প্রায় ২১ বছর আগে বিয়ের পর থেকে জ্যোতির ওপর নেমে আসে শ্বশুরবাড়ি সদস্যদের পাশবিক নির্যাতন। বিনা কারণেই জ্যোতিকে মারধর করতেন স্বামী, শাশুড়ি, দেবর ও জাসহ অন্যরা।
তিনি বলেন, গত বৃহস্পতিবার (১৫ সেপ্টেম্বর) গুরুতর অসুস্থ হলেও জ্যোতিকে হাসপাতালে নেয়া হয়নি। পরবর্তীতে শুক্রবার (১৬ সেপ্টেম্বর) পরিস্থিতি বেগতিক হওয়ায় বাধ্য হয়ে জ্যোতিকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।
সেখানে আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় জ্যোতির। কিন্তু জ্যোতির মরদেহ নিতে আসেননি তার স্বামী সুমিত কুমার আগারওয়াল। পরে জ্যোতির বড় ছেলে রাঘব আগারওয়াল তার মায়ের মরদেহ গ্রহণ করেন। এ ঘটনায় জ্যোতির স্বামীসহ অন্যদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়।
জ্যোতির বৌদি শষী দেবী বলেন, জ্যোতি দুই সন্তানের দিকে তাকিয়ে অনেক নির্যাতন সহ্য করে দীর্ঘদিন থেকে সংসার করে আসছিলেন। কিন্তু তার ওপর নির্যাতন যেন থামছিল না। এ সময় জ্যোতির নির্যাতনের ঘটনায় বিচার দাবি করেন তিনি।
তিনি বলেন, জ্যোতির মরদেহ হস্তান্তরের জন্য স্বামী সুমিত কুমার আগারওয়াল নিক্কিকে খোঁজাখুঁজি করা হলেও তিনি নিখোঁজ। নিজের স্ত্রীর মরদেহ নিতেও আসেননি তিনি।
জ্যোতির বড় ছেলে রাঘব আগারওয়াল ভারতে পড়াশোনা করেন। মায়ের হাসপাতালে ভর্তির সংবাদে দেশে ফিরে আসলেও মায়ের সঙ্গে কথা বলতে পারেননি।
মাকে হারিয়ে দিশেহারা অবস্থায় তিনি বলেন, ‘আমার মায়ের কী হয়েছে, কীভাবে হাসপাতালে আসলো আমি কিছুই জানি না। এরপর জলে ভরে ওঠে পনের বছর বয়সী জ্যোতির সন্তানের চোখ।’
জ্যোতি আগারওয়াল শহরের সুপরিচিত ব্যবসায়ী সুমিত কুমার আগারওয়াল নিক্কির স্ত্রী। তার বাবার বাড়ি নারায়ণগঞ্জে। সুমিত কুমার আগারওয়াল নিক্কি সৈয়দপুর উপজেলা হিন্দু কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সিনিয়র সহ-সভাপতি।
জানা যায়, এক সপ্তাহ আগে দুই পৃষ্ঠার সুইসাইড নোট লিখে তার ছবি তুলে সৈয়দপুর হিন্দু কমিউনিটির ব্যক্তিবর্গের কাছে মেসেঞ্জারসহ বিভিন্ন মাধ্যমে ছড়িয়ে দেন জ্যোতি। কিন্তু কেউই তার ওপর পারিবারিক অত্যাচারের বিষয়ে সুরাহা করতে এগিয়ে না আসায় গত বৃহস্পতিবার (১৫ সেপ্টেম্বর) দিবাগত রাতে ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন।
গুরুতর অবস্থায় উদ্ধার করে তাকে হাসপাতালে না নিয়ে পারিবারিকভাবে চিকিৎসা করাতে থাকেন নিক্কির ছোট ভাই অমিত কুমার আগারওয়ালের স্ত্রী ডা. অমৃতা কুমারী আগারওয়াল। এতে তার অবস্থার আরও অবনতি হয়।
পরিস্থিতি বেগতিক হওয়ায় শুক্রবার (১৬ সেপ্টেম্বর) রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয় জ্যোতি আগারওয়ালকে। তিন দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে রমেকের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন থেকে রোববার মারা যান জ্যোতি।
দুই পৃষ্ঠার সুইসাইড নোটে জ্যোতি লিখেছেন: ‘আমার বিয়ে হয়েছে ২০০১ সালের ১২ ডিসেম্বর। বিয়ের পর থেকেই শাশুড়ি ও স্বামী-দেবর মানসিক নির্যাতন করছেন। দেবরের বিয়ের পর জা অমৃতাও তাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে অত্যাচার চালিয়ে আসছেন। এরা আমাকে চারবার মেরে ফেলার চেষ্টাও করেছেন। বেঁচে আছি সেটা আমার ভাগ্য।
‘আমাকে সাজিয়ে মিথ্যে বলে আমার গয়না ও জমানো টাকা নিয়েছেন তারা। ফেরত দেবে বলে আজও দেননি; বরং টাকা ও গয়নার কথা বললেই অত্যাচারের মাত্রা বাড়ায়। গায়েও হাত তুলেছে সবাই মিলে। আমার মা-বাবা নেই। ভাই-বোনদের জন্য বেঁচে ছিলাম। কে জানত ওরা আমাকে মেরে ফেলবে? তাহলে তো ভাই-বোনরা ছেড়ে দিত না।
‘শাশুড়ি উমা দেবী আমাকে কখনো দেখতে পারেননি, ভালোও বাসেননি। আমার সংসার ভাঙার পেছনেও তার হাত রয়েছে। তিনি উল্টাপাল্টা বলে তার ছেলে সুমিতের কান ভরতেন। এমনকি আমার বাচ্চা দুটোকেও এরা ভয় দেখিয়ে রাখেন। এ কারণে তারা কিছু বলতে পারে না।’ বাচ্চাদের রক্ষার জন্যও আকুতি জানিয়েছেন জ্যোতি।
জ্যোতি আরও লিখেছেন: ‘মানুষ মৃত্যুর সময় কখনো মিথ্যে বলে না। বিশ্বাস না হলে কাজের লোক ও পাড়া-প্রতিবেশীদের জিজ্ঞেস করে দেখবেন। আমার শাশুড়ি অনেক অত্যাচার করেছে। ২১ বছর ধরে আমি শুধু কাঁদছি। এরা কখনোই সুখের দিন দেখতে দেয়নি। আমার মৃত্যুর বিচার চাই।’
তবে শনিবার জ্যোতির স্বামী সুমিত কুমার আগারওয়াল নিক্কি মোবাইল ফোনে বলেন, ‘সুইসাইড নোট বলে যে উড়ো চিঠির কথা প্রচার করা হচ্ছে, তা সঠিক নয়। কারণ, এটি আমার স্ত্রীর লেখা নয়। তার হাতের লেখার সঙ্গে এর কোনো মিল নেই। কীভাবে প্রমাণ করবেন যে চিঠিটা জ্যোতি লিখেছে?’
বাংলাদেশ সময়: ১৩:১৯:২৩ ৯৮ বার পঠিত